বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি একটি আইনি ক্ষমতা ব্যবহার করে দেশে দুজন মানুষকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। এ দুজন হলেন, শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ বেগম খালেদা জিয়া এবং ঘনিষ্ট মিত্র, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। যে আইনের আওতায় বিপরীত মেরুর দুই ব্যক্তিকে সরকার সুবিধা দিলো, সেটি একটি ফৌজদারি আইন। কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিওরের ৪০১ ধারায় বলবৎ এ আইন। অতি শক্তিশালী এ আইনের আওতায় সরকার যেকোনো কারাদণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করতে পারে।

বাংলাদেশের বিতর্কিত সাবেক সেনাপ্রধান, আওয়ামী লীগ নেত্রী হাসিনার ঘনিষ্ট জেনারেল আজিজ তিন বছর পদস্থ থেকে গত জুনে নিজ মেয়াদ শেষ করেছেন। উল্লেখিত আইনটি ব্যবহার করে সাবেক এই সেনাপ্রধানের দুই ভাইকে খুনের সাজা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে খুনের দায়ে এ দুই ভাইকে ২০০৪ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।

অপরদিকে, হাসিনার প্রতিপক্ষ খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে আইনটি ব্যবহার করা হয় ২০২০-এর মার্চে। এর মাধ্যমে তার ১০ বছরের কারাদণ্ড সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। খালেদা জিয়া যেন প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে পারেন, সেজন্যই আইনটি প্রয়োগ করে তার সাজা সাময়িক স্থগিত করা হয়।

যে আইনের সাহায্যে আদালতের রায় নাকচ বা পরিবর্তন করার মতো ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে তুলে দেয়া যায়, এমন আইন বিপদজনক। এটা একটা দেশের আইনের শাসন এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, এ দুয়ের জন্যই বিপজ্জনক। এমন আইন ক্ষমতার মারাত্মক অপব্যবহারের একচ্ছত্র সুযোগ সৃষ্টি করে। রায়ের পর যদি সাজা স্থগিত বা লাঘব করতেই হয়, তবে সে ক্ষমতা থাকা উচিত শুধুমাত্র আদালতের এখতিয়ারে। আইনের শাসনের এই নীতি বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। কেননা এখানে বিচার বিভাগীয় ও নির্বাহী সিদ্ধান্তের মধ্যকার সীমারেখা প্রকৃত পক্ষে বর্তমানে বিলুপ্ত। আদালত, সরকারের আজ্ঞাবহ হওয়ায় নির্বাহী বিভাগ যে সিদ্ধান্ত চায় আর আদালত যে সিদ্ধান্ত দেয়, বাস্তবে তাতে এখন আর কোনো ফারাক পাওয়া যায় না।

সরকার আইনটি কিভাবে ব্যবহার করেছে, সেদিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ট জেনারেলকে দেয়া সুবিধার তুলনায় প্রতিপক্ষের দলনেত্রীকে দেয়া হয়েছে নামকাওয়াস্তে সুবিধা।

আইনটি ব্যবহার করে সরকার জেনারেল আজিজের ভাইদের সাজা সম্পূর্ণ মওকুফ করেছিল। খুনের দায়ে যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া এবং সেই রায় এ্যাপেলেট ডিভিশনে বহাল থাকার পরও আজিজের দুই পলাতক ভাইকে একদিনও জেল খাটতে হয়নি। উপরন্তু সরকার তাদের দণ্ড মওকুফ করে দেয়।

আর বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের দুর্নীতি মামলার রায় এখনো আপিল বিভাগে রয়েছে। এছাড়া তিনি ইতিমধ্যেই প্রাপ্য দণ্ড ভোগ করছিলেন। তারপরও তার ক্ষেত্রে সাজা শুধুমাত্র সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। প্রতি ছয় মাস অন্তর এই সাময়িক স্থগিত আদেশ বর্ধন সাপেক্ষ। সেই সঙ্গে শর্ত রয়েছে, খালেদা জিয়াকে “তার ঢাকাস্থ বাসস্থানে থেকে চিকিৎসা গ্রহণ” করতে হবে এবং তিনি “বিদেশে ভ্রমণ” করতে পারবেন না।

খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় বিএনপি তাদের নেত্রীকে দেশ ত্যাগের অনুমতি দিতে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে। বিএনপি নেত্রীর যকৃত বা লিভার সোরোসিস ধরা পড়েছে। তার চিকিৎসক বলেছেন, “পুনরায় রক্তক্ষরণ বন্ধের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এখানে নাই।’’ তিনি আরও জানিয়েছেন, “রোগীর জীবন রক্ষা করতে হলে” তার ট্রান্সজাগিউলার ইন্ট্রাহেপাটিক পোর্টোসিস্টেমিক শান্ট (যকৃতের ভেতর শিরা জোড়া দেবার প্রণালী) প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে এর কোনো ব্যবস্থা নাই।

কিন্তু সরকার বিএনপির এ আবেদন নাকচ করে দিয়েছে। জানিয়েছে, এ বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপের কোনো ক্ষমতা নাই। এ সিদ্ধান্তের ক্ষমতা শুধুমাত্র আদালতের।

প্রধানমন্ত্রী গত ১৭ নভেম্বর বলেছেন, “খালেদা জিয়ার জন্য যা করা যায়, আমি করেছি। এরপর যা হবে, তা আইন অনুযায়ী হবে।’’ তার ঠিক পরের দিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংসদে বলেন, সাজাপ্রাপ্ত আসামি হবার কারণে খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে পাঠাবার “আইনি সুযোগ নাই। [বিএনপি] আমাকে যতোই নিন্দা করুক, তাতে কিছু আসে যায় না। আমি আইন অনুসরণ করব।” এর দুদিন পর তিনি এ অবস্থান আবারো নিশ্চিত করেন। তারপর সম্প্রতি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে এক বৈঠকে আবারো একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া চাইলে বিদেশ থেকে ডাক্তার বাংলাদেশে নিয়ে আসতে পারেন।

অথচ কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিওরের ৪০১ ধারায় পরিষ্কারভাবে যেকোনো শর্ত সাপেক্ষে খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফ বা স্থগিত করার ক্ষমতা সরকারের হাতে দেয়া আছে। সরকার জেনারেল আজিজের খুনি ভাইদের সাজা মওকুফে সম্প্রতি এ ক্ষমতা ব্যবহারও করেছে। এদিকে এ ক্ষমতা আইনে থাকলেই তা পলাতক আসামির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অনেকে।

কাজেই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বোঝা যাচ্ছে, সরকার আইনি ক্ষমতা ব্যবহার করে খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে দেবে কিনা, তার সঙ্গে আদালতের সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক নাই। এ ধরনের দাবি সম্পূর্ণ বাখোয়াজ। এক সময় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একজন বিশ্বাসযোগ্য ও শ্রদ্ধাভাজন আইনজীবী ছিলেন। কিন্তু এখন তিনি তার নেত্রীর শেখানো বুলি ছাড়া কিছু বলতে পারেন বলে মনে হয় না।

জেনারেল আজিজের দুই ভাইয়ের সাজা মাফের সিদ্ধান্ত যেমন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক — যার পেছনে নিঃসন্দেহে ছিল আজিজের বিশ্বস্ততার হিসেব — তেমনি খালেদা জিয়াকে বিদেশ যেতে দেয়া হবে কিনা, সেটাও সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

এক্ষেত্রে যেহেতু বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই সিদ্ধান্ত দেবেন, তাই দেখা যাক তিনি কী কী বিষয় বিবেচনা করবেন।

হাসিনা-খালেদা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং ব্যক্তিগতভাবেও তাদের সম্পর্ক তিক্ত। শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ২১ আগস্ট তার উপর গ্রেনেড হামলা ও হত্যা চেষ্টার জন্য সরাসরি খালেদা জিয়াকে দায়ী করেন। এছাড়া তার বাবা ও পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারী লোকজনকে সম্মানজনক বিভিন্ন পদে নিযুক্ত করার জন্যও খালেদা জিয়াকে দোষী মনে করেন। এসব ছাড়াও খালেদা জিয়ার বিদেশে যাবার সিদ্ধান্তে বিদ্যমান অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনাও গুরুত্ব পাবে।

বহু বছর বিএনপির উপর দমন ও নিপড়ন চালানো হলেও দলটি টিকে আছে। শুধু তাই না, এতকিছুর পরও সরকারের প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে এখনো বিএনপিই আছে। বিএনপির সবচেয়ে বড় শক্তি সম্ভবত — এবং খানিকটা বিস্ময়করও হয়ত — খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা। এর অর্থ এই নয় যে খালেদা জিয়াসহ বিএনপি একটি স্বাধীন ও সুষ্ঠ নির্বাচনে অংশ নিলেই জিতে যাবে (তেমন নির্বাচন হবার সম্ভাবনা অবশ্য শূন্যের কাছাকাছি)। তবে খালেদা জিয়ার গুরুত্ব এই যে তাকে ছাড়া বিএনপি মোটামুটি অচল বলেই মনে হয়।

তাই খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে যে শেখ হাসিনা রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবেন, তা তিনি জানেন। এটাও শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে বিএনপির চেয়ারপার্সনের বিদেশ যাবার আবেদন প্রত্যাখ্যানের অন্যতম কারণ বলে ধরা যায়।

তবে খালেদা জিয়া মারা গেলে এর তাৎক্ষণিক পরিণতি হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার একটি সম্ভাব্য হুমকির মুখে পড়বে। কারণ খালেদার মৃত্যুতে বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ফলসরূপ ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে তারা পথে নেমে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার মৃত্যু সরকারের জন্য নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করবে।

প্রশ্ন হলো, তাহলে খালেদা জিয়ার মৃত্যু বিদেশে হলেই কী সরকারের জন্য বেশি লাভজনক হয় না? আর এটাই যদি হয়, তো চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশ যেতে বাধা দেবার দোষ তো প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া যায় না! তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়, খালেদা জিয়ার দাফন কোথায় হবে? ধারনা করা স্বাভাবিক যে দেশেই তা হবার কথা। সেক্ষেত্রেও সরকারের জন্য কঠিন একটি পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

এসব বিবেচনা করলে বোঝা যায়, কেন বিএনপির অসুস্থ নেত্রীকে এখনো শেখ হাসিনা দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য যেতে দিচ্ছেন না।

খালেদা জিয়া এতটা অসুস্থ নন যে তাকে মৃত্যুশয্যায় আছেন বলা যাবে। যদি তিনি সঠিক চিকিৎসা পান, তবে হয়ত সুস্থ্য হয়ে উঠবেন। বাংলাদেশে ফিরে আসবেন আরও বেশি শক্তিশালী নেতা হিসেবে। শেখ হাসিনার জন্য ভালো হয়, যদি খালেদা জিয়াকে এমন সময় বিদেশে পাঠানো যায় যে তিনি আর সুস্থ হয়ে উঠতে পারবেন না এবং বিদেশেই মারা যান। বিএনপির ভেতরের সূত্র অনুসারে জানা যায়, আইনমন্ত্রী নিয়মিত খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর রাখছেন। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, কখন খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানো আওয়ামী লীগের জন্য ভালো হবে, তা সুকৌশলে নির্ধারণ করাই এই খোজঁখবরের উদ্দেশ্য।

যদিও খালেদার দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত আদালতের হাতেই থাকার কথা, কিন্তু বিদ্যমান আইনে নির্বাহী বিভাগ চাইলে এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সরকার সম্প্রতি এ আইনি ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করেছে দণ্ডপ্রাপ্ত ও পলাতক দুই খুনের আসামিকে দণ্ড থেকে মুক্তি দিতে। কাজেই একই আইন নিজেদের প্রতিপক্ষের ক্ষেত্রে — বিশেষ করে যেখানে একজনের জীবন বাচঁতে পারে — সেখানে কেন তা প্রয়োগ করা হবে না, তার সাফাই দেয়া সরকারের পক্ষে মুশকিল হবে।

ডেভিড বার্গম্যান : বৃটেনভিত্তিক সাংবাদিক। তার এই লেখাটি নেওয়া হয়েছে নেত্র নিউজ থেকে।